Bangla24.Net

বৃহস্পতিবার, ১২ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৮শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন

তফসিল ঘোষণার আগে সমঝোতা জরুরি

বর্তমান একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ২৯ জানুয়ারি। সংবিধান অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের তিন মাসের মধ্যে পরবর্তী নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। সেই হিসেবে আগামী ১ নভেম্বর থেকে শুরু হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া।

নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে বিএনপিসহ তাদের সমমনা দলগুলো। আর আওয়ামী লীগসহ ক্ষমতাসীন জোট বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শনিবার নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে আগামী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। সেই হিসেবে নভেম্বরে নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা হবে।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার আগে দেশের প্রধান দুই দলের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা জরুরি। কারণ কোনো একটি বৃহৎ দলকে বাদ দিয়ে একতরফা নির্বাচন হলে দেশের সংকট আরও বাড়বে।

শনিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল নির্বাচনি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম উদ্বোধন করেছেন। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়ে গেল বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান। নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হওয়াকে স্বাগত জানিয়ে বিশিষ্টজনরা বলছেন, সবচেয়ে আগে দরকার রাজনৈতিক সমঝোতা। তা না হলে প্রধান দুই দল তাদের পাল্টাপাল্টি সিদ্ধান্তে অনড় থাকলে দেশে রাজনৈতিক সংকট আরও বাড়বে। তাই কিছুটা ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে দুই দলকেই এগিয়ে আসতে হবে। সমঝোতা না হলে রাজনীতি সংঘাতের দিকে যাবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন সম্পন্ন করা, যাতে দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কার্যকর হয়। একতরফা নির্বাচন কোনো নির্বাচনই নয়। নির্বাচন করতে হলে প্রতিদ্বন্দ্বী থাকতে হয়। রকিব উদ্দিন কমিশন ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন করতে যদি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করত তা হলে বাংলাদেশের ইতিহাসে বিদ্যমান এই পরিস্থিতি দেখতে হতো না। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, এই নির্বাচন কমিশনও পক্ষপাতদুষ্ট, এই হলো সমস্যা।

তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনকে এখন রাজনৈতিক দলগুলোর বলা উচিত যে, আমাদের সাংবিধানিক ম্যান্ডেট হলো একটা নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা। একতরফা নির্বাচন কোনো নির্বাচনই নয়। তাই আপনারা যদি একটা সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারেন তা হলে আমাদের পক্ষে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার জন্য কমিশনেরও দায়িত্ব রয়েছে।

সুজন সম্পাদক বলেন, দুই রাজনৈতিক পক্ষই যদি তাদের এক দফা নিয়ে অনড় অবস্থানে থাকে তা হলে আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের পথ আরও কঠিন হবে। যার যার অবস্থানে তারা অনড় থাকলে দেশে সহিংসতা, উত্তাপ, উত্তেজনা বাড়বে-যা দেশবাসীর জন্য অমঙ্গল। এতে দেশবাসীর মধ্যে উৎকণ্ঠা আরও বাড়বে। তাই সাধারণ মানুষের উদ্বেগ এবং দেশের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দেশের শীর্ষ দুই রাজনৈতিক দলকেও একটি ইতিবাচক সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার আগেই রাজনৈতিক সমঝোতা জরুরি।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে ভোট করতে হবে। তাই রাজনৈতিক সমঝোতা হোক বা না হোক কমিশনকে কিন্তু নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। আর পুলিশ ও প্রশাসন সহায়তা করলে যেভাবেই হোক না কেন কমিশন নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারবে। কারণ আমাদের দেশে এরকম পাল্টাপাল্টি অবস্থান নতুন নয়। এরশাদ সরকারের আমল থেকেই হয়ে আসছে। তখনও বলা হয়েছিল এরশাদ পদত্যাগ না হলে নির্বাচন করতে দেয়া হবে না। কিন্তু এরশাদ ১৯৮৮ সালে নির্বাচন করেছিলেন। যদিও পরে আন্দোলনের মুখে এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

ঠিক একইভাবে ১৯৯৬ সালেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দল। কিন্তু দাবি না মেনে বিএনপি নির্বাচন করেছিল। যদিও পরবর্তী সময়ে কয়েক মাস পর আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিল। তাই বিএনপি নির্বাচনে না এলেও সেনাবাহিনী, প্রশাসন ও পুলিশ সহায়তা করলে ইসি নির্বাচন করতে পারবে। তবে নির্বাচনের সময় পরিবেশ কেমন থাকবে তার ওপর পরিস্থিতি নির্ভর করছে।

সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বিদেশি কূটনীতিকরা সবাই চাইছেন দেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে কিন্তু নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। কারণ তাদেরও বড় একটা জনসমর্থন আছে। তবে কোনো দল নির্বাচনে না এলে এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের করণীয় কিছু নেই। কারণ সংবিধান ও আইন দিয়ে ইসির হাত-পা বাঁধা। তাই সংবিধান অনুযায়ী তাদের নির্বাচন করতে হবে। তবে জনগণের স্বার্থে রাজনৈতিক সমঝোতা খুবই জরুরি। এটা হলে রাজনৈতিক সংঘাত এড়ানো সম্ভব হবে, জানমালের ক্ষতি হবে না। রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে এ দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রধান শর্ত হচ্ছে নির্বাচন। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাও সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ভারতসহ অন্যান্য দেশে নির্বাচন কমিশনের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা থাকলেও আমাদের এখানে আস্থার একটা সংকট আছে। সে কারণে আলোচনার মাধ্যমে যদি সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করা যায় তা হলে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও তৈরি হবে। এ ক্ষেত্রে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলকেও কিছুটা ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে সমঝোতার দিকে এগিয়ে আসতে হবে। নির্বাচন কমিশনেরও উচিত সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

সৌজন্যে : সময়ের আলো

শেয়ার