Bangla24.Net

ভোটের আগে জাপায় নাটক

চেয়ারম্যান পদ নিয়ে জাতীয় পার্টিতে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এ পদ নিয়ে দেবর-ভাবির দ্বন্দ্ব আবারও সামনে এসেছে। দেবর জিএম কাদের যখন ভারত সফরে আছেন তখন খবর আসে জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিলেন রওশন এরশাদ। এমন তথ্য জানিয়ে তার পক্ষ থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আসে মঙ্গলবার সকালে।

যেখানে রওশন এরশাদের স্বাক্ষর সংবলিত প্যাডে বলা হয়, ‘আমি রওশন এরশাদ। সিনিয়র নেতাদের পরামর্শ ও সিদ্ধান্তে দলের গতিশীলতা ধরে রাখার স্বার্থে জাপার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করলাম।’ যদিও এ বিষয়ে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ পরিষ্কার করেননি।

তিনি বলেন, ‘যারা প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে তাদের জিজ্ঞেস করেন। তারা বিস্তারিত বলতে পারবে। আপনারা রয়েসয়ে নিউজ করেন।’ পরে মঙ্গলবার বিকালে তিনি সময়ের আলোকে সাফ জানিয়ে দেন, ‘ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি সঠিক নয়। পার্টির চেয়ারম্যান নই, সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান আমি।’

দশম জাতীয় কাউন্সিল সামনে রেখে মঙ্গলবার সকালে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের ঘোষণা দেন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ। তবে বিকালে তিনি তা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান আমি। সকালের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু ভুলবশত দলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের চিঠি গণমাধ্যমে চলে গেছে। আমি পার্টির চেয়ারম্যান নই। এটা ভুল হয়েছে।’

এর আগে সকালে জাপার প্যাডে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দশম জাতীয় কাউন্সিলকে সামনে রেখে পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিলেন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ। জাতীয় পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ কো-চেয়ারম্যানদের পূর্বে নেওয়া সিদ্ধান্ত মঙ্গলবার সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেন পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ। সে অনুযায়ী আসন্ন দশম জাতীয় সম্মেলন পর্যন্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন তিনি।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, এর আগে জাতীয় পার্টির অধিকাংশ প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ সদস্যের মতামত এবং চারজন কো-চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে পার্টির চলমান ক্রান্তিকাল মোকাবিলায় দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। মেয়াদাত্তীর্ণ কমিটি, নানা ধরনের মামলা মোকদ্দমা এবং দল পরিচালনায় অযোগ্যতা ও অসাংগঠনিক আচরণের কারণে জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে (জিএম) অব্যাহতি দেওয়া হয়।

প্যাডে স্বাক্ষর থাকা জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি বলেন, ‘কে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে আমি জানি না। আমি কোনো স্বাক্ষর করিনি।’ পার্টির আরেক কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা সময়ের আলোকে বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা বানোয়াট, ভিত্তিহীন খবর। আমরা কোনো স্বাক্ষর দিইনি। আমাদের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে এমন বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। আমি পার্টির জন্মলগ্ন থেকে আছি। আমার বিশ্বাস-ম্যাডাম রওশন এরশাদ নিজেও এটা জানেন না। সম্মেলন ছাড়া চেয়ারম্যান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই পার্টির গঠনতন্ত্রে।’ প্যাডে স্বাক্ষর থাকা জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু সময়ের আলোকে বলেন, ‘অসুস্থ থাকার সময় আমরা ম্যাডামকে দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে ম্যাডামের আশপাশে ঘুরঘুর করা কয়েকজন ব্যক্তি উপস্থিতির স্বাক্ষর নেয়। এই স্বাক্ষর নকল করে এখন তারা ম্যাডামকে চেয়ারম্যান বানিয়ে দিয়েছি। এটা মতলববাজদের কাজ।’

রওশন এরশাদ নিজেকে পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করা যে বিজ্ঞপ্তি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে তা ভুয়া বলে জানান বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ। সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, বেগম রওশন এরশাদ এ বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে কিছুই জানেন না। নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা তো প্রশ্নই আসে না। আমাদেরই কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে ওই বিজ্ঞপ্তি ছড়িয়েছে। তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যে কেউ ইচ্ছে করলেই চেয়ারম্যান ঘোষণা করতে পারেন না। একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চেয়ারম্যান নির্বাচন করা হয়।

জানা গেছে, কাজী লুৎফুল কবীর নামের একজন ‘প্রেস নোট (জাপা)’ নামের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এই বিজ্ঞপ্তি দেন। কাজী লুৎফুল কবীর দীর্ঘদিন ধরে এই গ্রুপ থেকেই রওশন এরশাদ ও তার মুখপাত্র কাজী মামুনূর রশিদের পক্ষে বিবৃতি পাঠিয়ে আসছেন। কাজী লুৎফুল কবীর সময়ের আলোকে বলেন, আমি একজন সংবাদকর্মী। আমি তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সংক্রান্ত কাজে সহায়তা করি। তাদের অনুমোদন নিয়েই বিজ্ঞপ্তিটি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়।

এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু এমপি বলেছেন, চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের এমপিকে অব্যাহতি দেয়ার খবরটি ভুয়া। প্যাডে কেউ স্বাক্ষর করেননি। স্বাক্ষর দেয়ার প্রশ্নই আসে না। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যে কেউ ইচ্ছে করলেই চেয়ারম্যানকে অব্যাহতি দিতে পারে না। গঠনতন্ত্রের বাইরে কেউই কিছু করতে পারবে না। জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কৃৃত কিছু ব্যক্তি ম্যাডামের নাম ব্যবহার করে এমন একটি ফেক নিউজ দিয়েছে।

জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর তার ভাই জিএম কাদের ও স্ত্রী বেগম রওশন এরশাদের মধ্যে দলের নেতৃত্ব নিয়ে টানাপড়েন দেখা দেয়। সে সময় জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান ও রওশনকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক করে সামাল দেয়া হয়। গত বছরের ৩১ আগস্ট হঠাৎ করেই এক চিঠিতে দলের কাউন্সিল আহ্বান করেন রওশন। তবে জিএম কাদেরের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই পদক্ষেপ অবৈধ, কারণ, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাউন্সিল আহ্বানের ক্ষমতা আছে কেবল তার। এরপর জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে আদালতেও মামলা করা হয়। দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের মধ্যে গত ১৩ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির দুই নেতা একসঙ্গে গিয়ে দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। সে সময় দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার কথাও জানানো হয়।

গত কয়েক মাস ধরেই জিএম কাদের সরকারের সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন। আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলের অবস্থান কী হবে, সে বিষয়টি স্পষ্ট করছিলেন না তিনি। জাতীয় নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টির এমন নাটকীয়তা নতুন নয়। ১৯৯৯ সালে জাতীয় পার্টি বিএনপির সঙ্গে জোটে গেলেও ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে সে জোট থেকে বের হয়ে আসে। এ নিয়ে তখন দলে ভাঙন ধরে। বিজেপি নামে দল গঠন করে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জোটে থেকে যায় একটি অংশ। ২০০৬ সালে বিএনপিবিরোধী আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয় জাতীয় পার্টি। ২০০৮ সালে জোটবদ্ধ হয়েই তারা যায় ভোটে।

বিরোধী দল হয়েও সরকারের প্রভাব থেকে বের হতে না পারা জাতীয় পার্টি ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের আগে একেক সময় একেক অবস্থান নেয়। ভোটের আগে আগে এরশাদের অসুস্থতার কথা বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করে। বেগম রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একাংশ যায় ভোটে। ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচেনর আগেও প্রায় একই পরিস্থিতি তৈরি হয়।

আগামী জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টি কী করবে, এই আলোচনার মধ্যে গত ২০ আগস্ট ভারতের আমন্ত্রণে নয়াদিল্লি যান জিএম কাদের। জিএম কাদের তিন সদস্য নিয়ে তিন দিনের ভারত সফরে আছেন। আজ বুধবার সন্ধ্যায় দেশে ফেরার কথা রয়েছে তাদের। এর আগের দিন গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন রওশন এরশাদ। সেখানে জিএম কাদেরের বিষোদগার করেন তিনি-এ মর্মে সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

সৌজন্য : সময়ের আলো

শেয়ার