Bangla24.Net

নির্মলেন্দু গুণের কবিতার জমিন

সমকালীন বাংলা কাব্যসাহিত্যে যে কয়জন কবি শ্রেষ্ঠত্ব-শিরোপার দাবিদার কবি নির্মলেন্দু গুণ তাদের মধ্যে অন্যতম। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা কাব্যভুবনে আবির্ভূত হয়েছেন তিনি। ষাটের রাজনীতির সেই উত্তাল সময়ে বাংলা কাব্যাঙ্গনেও সৃষ্টির জোয়ার বয়ে যায়। চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের ধারাক্রমে বাংলাদেশের কাব্যভুবনকে সুফলা ভূমিতে রূপায়িত করতে ষাটের দশক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

সময়ের হাত ধরে এসেছেন প্রতিশ্রুতিশীল কবির দল, যারা জীবন ও সমাজবাস্তবতার প্রতিরূপ হিসেবে বাঙালি পাঠককে উপহার দিয়েছেন অনেক সফল কবিতা। শিল্পসিদ্ধির কথা ভেবে কোনো কবি লেখেন না; তার রচনায় নির্ধারণ করে নেন শিল্পের প্রকৃতি ও তার পথ। নির্মলেন্দু গুণ স্বভাব-কবি। স্বভাব-কবির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার যেকোনো অনুভব স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত হবে এবং সহজেই কাব্যরূপ লাভ করবে। সহজ কথাকেও কবিতা করে তোলার ক্ষমতা এদের স্বভাবজাত।

নেত্রকোনার কাশবনে বাতাসে যে কাব্যভাবনার অঙ্কুরোদগম হয়েছিল ষাটের প্রথম পাদে, তা ফুলে-ফলে বিকশিত হতে শুরু করে মধ্য ষাটে এসে ঢাকার জল ও হাওয়ায়। যখন তিনি বুঝেছিলেন কবিতাই তার একমাত্র আরাধ্য, তখন তিনি আর কোনোদিকে তাকাননি। কবিতাকে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন জীবনের প্রকৃত সহযাত্রী হিসেবে। যাপন করেছেন বোহেমিয়ান জীবন। ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং স্বাধীন জীবনযাপনই মুখ্য হয়ে ওঠে তার। কবিতার আরাধনা ছাড়া ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যও গৌণ ছিল তার কাছে। কবিতালগ্ন এই কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ প্রকাশিত হয় ঊনসত্তরের উত্তাল কাল পরিসর পেরিয়ে ১৯৭০-এ। চমকে দেওয়া নাম! যদি প্রেমাংশু, তবে রক্ত কেন? এই পরস্পরবিরোধী সত্তার আবহজাত হয়ে পাঠকের হাতে এলো নির্মলেন্দু গুণের প্রথম কাব্যফসল। আমরা তখন বিশ^বিদ্যালয়ের নবীন ছাত্র। কবিতাঙ্গনে সবে বিচরণ শুরু, কবিতা-প্রাণ যুবক। কাব্যভাবনায় উদ্বুদ্ধ হচ্ছি। গ্রন্থটি আলাদা আবেদন নিয়ে উপস্থিত হলো পাঠকের সামনে।

বলছিলাম নাম প্রসঙ্গে। নামের মাহাত্ম্য নিয়ে নানা জনের নানা মত আছে। আমি নামের চমৎকারিত্বে আস্থাবান। কবিতার নাম, কাব্যগ্রন্থের নাম কিংবা অন্য কারও পরিচয়জ্ঞাপক উচ্চারণ চমকপ্রদ হবে, তা সবাই চায়। আবার তা স্বতঃস্ফূর্তও হতে হবে। কাজ যে অর্থে সহজ সে অর্থে কিছুটা কঠিনও বইকি। এখানেই প্রকৃত কবির বাহাদুরি। কবিতার বোদ্ধা পাঠক স্বতঃস্ফূর্ত ও আরোপিত শব্দের প্রয়োগ সহজে অনুধাবন করতে পারে। নামের ব্যাপারে কবি নির্মলেন্দু গুণের কৃতিত্ব এখানে যে, তার দেওয়া কাব্য-নাম সব ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ত এবং চমকপ্রদ হয়েছে। প্রথম গ্রন্থের নামকে বলেছি পরস্পর বিরোধ ভাব-আক্রান্ত। দ্বিতীয় গ্রন্থের নামের মধ্যেও তা লক্ষণীয়-‘না প্রেমিক না বিপ্লবী’। এই নামকরণে আর খটকা লাগে না, তবে চমকপ্রদ। নামে যদিও আছে বিরোধাভাস। নির্মলেন্দু গুণ স্বভাবে প্রেমিক এবং একই সঙ্গে বিপ্লবী চেতনারও ধারক। বাংলাদেশের জন্মলগ্নের রক্তাক্ত স্মৃতিবহ সময় স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে কবির মনোজগতে প্রেমের পাশাপাশি বিপ্লবের সুর স্বভাবতই অনুরণিত হয়েছে বিরোধাভাসের মধ্য দিয়ে।

কবিতার পাঠকের কাছে কবি নির্মলেন্দু গুণ যেভাবে গ্রহণীয় হয়ে উঠলেন তা বজায় থাকল পরবর্তী সময়েও। একাত্তর-পরবর্তী সময়ে গুণ হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের কবিতার যুবরাজ। সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি। ঈর্ষার ব্যাপার তো বটেই। এই জনপ্রিয়তার মাপকাঠি কী? ভাবা সহজ কিংবা কঠিন। সহজ ভাবা যায় এ জন্য যে, গুণের কবিতার বইয়ের কাটতি সব সময়ই বেশি লক্ষ করা গেছে। পাঠকপ্রিয়তা তার বড় প্রাপ্তি তো বটেই। একজন লেখক তখনই পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠেন, যখন তার চিন্তা, তার অনুভব অন্যের চিন্তার সমীপবর্তী হয়। অন্যকেও কবির মতো করে ভাবায়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে বাচিকশিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। কবিতা আবৃত্তি রূপলাভ করে শিল্পে। এখন পর্যন্ত আবৃত্তি অনুষ্ঠানগুলোতে নির্মলেন্দু গুণ বেশি পঠিত হয় বলে জানা যায়। এই কারণকে অনেকে অনেকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা তা-ই। বলছি সাম্প্রতিক কবিতার কথা। যদি রবীন্দ্রনাথ-নজরুলকে আলোচনায় আনা হয়, তবে এই আলোচনার চেহারা ভিন্ন হবে। রবীন্দ্র-নজরুলের মতো গুণের কবিতাও পাঠকের মুখে প্রায়ই উচ্চারিত হয় এ দেশে।

নাম প্রসঙ্গে আলোচনা করছিলাম। তার পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলোর নামও স্বতঃস্ফূর্ত ও আকর্ষণীয়। ‘কবিতা, অমীমাংসিত রমণী’, ‘দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী’, ‘চৈত্রের ভালোবাসা’, ‘ও বন্ধু আমার’, ‘আনন্দ কুসুম’ এ রকম আকর্ষণীয় না সব। প্রেমের উজ্জ্বল উচ্চারণ এসব নাম। পরের গ্রন্থগুলোর নাম সমাজ সংলগ্ন কিন্তু নামের চমৎকারিত্ব অটুট আছে। ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘তার আগে চাই সমাজতন্ত্র’, ‘পৃথিবী জোড়া গান’ কিংবা ‘দূর হ দুঃশাসন’-এ রকম আরও। পাঠককে এমনিতেই টানে। এসব কাব্যে তার প্রেমিক-সত্তা আরও উদ্ভাসিত হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতি-সচেতনতাও। রাজনীতি ও মানুষের প্রতি কবির যে ভালোবাসা তাকেও ছাপিয়ে প্রেমিক সত্তাই এসব কাব্যে প্রখরতর হয়েছে। তার কাব্যজুড়ে রয়েছে পাওয়া না পাওয়ার হাহাকার, আনন্দ-বেদনার সংমিশ্রিত অনুরাগ। কবি একসময় প্রকাশ করলেন ‘মুঠোফোনের কাব্য’। নামের চমৎকারিত্ব তেমন নেই কিন্তু শ্লেষ আছে। নির্মলেন্দু গুণই প্রথম ‘মুঠোফোন’ নামটি ব্যবহার করলেন। মোবাইল ফোনে লিপিবদ্ধ কবির তাৎক্ষণিক অনুভবের গ্রন্থরূপ। মোবাইল ফোন তো মানুষের মুঠোর মধ্যেই থাকে, কবি নাম দিলেন ‘মুঠোফোন’। শব্দটি এখন চালু হয়ে গেছে। একদিন শব্দকোষেরও অন্তর্ভুক্ত হবে। এভাবেই কবি-লেখকরা শব্দ তৈরি করেন। শব্দ হচ্ছে অর্থবহ উচ্চারণ, যা কোনো কিছুর পরিচয় বা বিশেষণজ্ঞাপক হবে।
এই ‘মুঠোফোনের কাব্য’ যখন প্রকাশ করার উদ্যোগ নিলেন কবি, তখন তা যে প্রকাশককে দেওয়ার কথা হয়েছিল, কবি তার চাহিদা ও দুই প্রকাশকের আগ্রহের কথা চিন্তা করে দুজনকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

করলেনও তা। মুঠোফোনে লিপিবদ্ধ কাব্য পঙ্ক্তিগুলো একত্রিত করে দুভাগ করলেন এবং মুঠোফোনের কাব্য-১, মুঠোফোনের কাব্য-২ নামে। দিলেন দুই প্রকাশককে। তাতেও প্রকাশকরা খুশি ছিলেন। তবে কবি এখানে নিজের প্রতি কিছুটা অবিচার করেছেন। একজন প্রকাশক হলে কবিতাগুলো তিনি বাছাই করার সুযোগ পেতেন। এ ক্ষেত্রে তা করার সুযোগ হয়নি। কবির ভক্ত পাঠক তাও গ্রহণ করেছে। বইগুলো বিক্রিও হয়ে গেছে। নির্মলেন্দু গুণ বলে কথা। এর পরের গ্রন্থগুলোতে কবি অনেক যতœশীল, সমাজভাবনাপুষ্ট। দেশের প্রতি, সমাজের প্রতি কবির দায়বোধ জাতিকে দিয়েছে আত্ম-আবিষ্কারের মন্ত্রণা।

শেয়ার