Bangla24.Net

মঙ্গলবার, ১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২রা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইনহেলার

শীতকাল একেবারে পছন্দ নয় জোহরা বেগমের। শীতকাল এলেই যন্ত্রণার একশেষ। এমনিতে বাতাসে ধুলো ওড়ে তার সঙ্গে আর্দ্রতা কমে যায়। শীতকালে খুব শ্বাসকষ্ট শুরু হয় ওনার।

হাতের কাছেই বিছানার পাশে ছোট একটা নাইটস্ট্যান্ডে রাখা থাকে ওনার ইনহেলার। ওনাদের বংশে সবার হাঁপানি আছ। দমবন্ধ হয়ে যখন হাঁসফাঁস করেন এই ইনহেলার ওনার সবচেয়ে প্রিয় সহচর। ফুসফুস ভর্তি বাতাসের জন্য কেমন ডাঙায় ওঠা মাছের মতো তড়পাতে থাকেন।

ইনহেলারটা যতবার হাতে নেন ততবার ওনার চোখে আরেকজনের ছবি ভেসে ওঠে। মেহজাবিনের আব্বার কথা খুব মনে পড়ে। ওনারও হাঁপানি ছিল।

মেহজাবিন জোহরার একমাত্র মেয়ে। মেহজাবিনের বয়স হলো পঞ্চাশ। মেহজাবিনের জন্ম উনিশশ একাত্তরে। কেমন সব ওলটপালট মনে হয় ওনার। এই সেদিন না তিন মাস বয়স ছিল ওর। এত বড় কবে হয়ে গেল?

কড়ে গোনেন জোহরা। হ্যাঁ, ঠিকই তো ভাবছেন। মেহজাবিনের জন্ম জানুয়ারি মাসে। আর ওনাদের গ্রামে মিলিটারি এলো মার্চ মাসে। তখন মেহজাবিনের বয়স তিন মাসও হয়নি।

ঢাকা থেকে পালিয়ে উত্তরবঙ্গে গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। ওনার শ্বশুরবাড়ি একটা মহাসড়কের পাশে। ব্যস্ত রাস্তায় দিনরাত ধুলা উড়িয়ে বাস-ট্রাক চলত। একাত্তরের মার্চ মাসে সব যানবাহন চলাচল কমে এসেছিল। প্রায়ই শুনতেন আত্রাই নদীতে নাকি লাশ ভেসে আসে। একদিন সকালে ভেসে গেল এক কিশোরী কন্যার মৃতদেহ। বেআব্রু সেই মৃতদেহ দেখে সুবল মাঝি বাড়ি এসে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।

‘আহারে মেয়েটা আমার নারায়ণীর বয়সি কর্তা। আমি ঠিক করেছি বর্ডার পার হয়ে ভারতে চলে যাব।’ আকবর উত্তরে বললেন, ‘আমি আমার দেশ ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না। এখানেই থাকব।’

এর কয়েক দিন পরে সুবল মাঝি সপরিবারে দেশ ত্যাগ করলেন। মানুষটা গোঁয়ারের মতো থেকে গেলেন। ওনার ধারণা ছিল গ্রামে কখনো মিলিটারি আসবে না।

গ্রামের বাড়িতে লুকিয়ে নিশ্চিন্তই ছিলেন জোহরা। কোলে তিন মাসের বাচ্চা। গোয়ালে গরু আছে আর বাড়ির পেছনে মস্ত আমবাগান।আমগাছগুলোতে মুকুল এসেছিল কি সেই বছর? মনে করতে পারেন না জোহরা। তবে একটা কথা খুব মনে আছে সে বছর অনেক খেজুরের গুড় হয়েছিল। তাই তো বিকেল বেলা বসে মুড়ি দিয়ে মাখিয়ে খেতেন।

এখনও সেই স্বাদ যেন মুখে লেগে আছে। কচর-মচর করে মুড়ি চিবোতেন জোহরা। দুপুরে খাওয়া শেষে শাশুড়ি ভাতঘুম দিতেন। জোহরা মেয়েকে নিয়ে বসে একবার অর্থাৎ মেহজাবিনের বাবার সঙ্গে গল্প করতেন।

স্মৃতি বড় প্রবঞ্চক। আমরা যা ভুলতে চাই তা বারবার মনে করিয়ে দেবে। আর যা মনে রাখতে চাই তা ভুলিয়ে দেবে। ভদ্রলোক ঢাকায় থাকতে অফিস করতেন। কোনো দিন দুপুরে দেখা হতো না। জোহরার গ্রামের বাড়িতে থাকতে কেমন চড়ুইভাতি মনে হতো। ঠিক সন্ধ্যা বেলাতে ভেসে আসত মুয়াজ্জিনের আজানের স্বর। অল্প বয়সি ইমামের কণ্ঠস্বর সুরেলা। অন্তর থেকেই যেন বান্দাদের স্রষ্টার কাছে হাজির হওয়ার আহ্বান জানাতেন। বাড়ির পাশের মসজিদের ইমাম অল্প বয়সি এক ছেলে। একহারা লম্বা ছেলেটা এতিম। জোহরাকে দেখলেই একগাল হেসে জিজ্ঞেস করত, ‘চাচি ভালো আছেন?’

জোহরা মাথায় এক হাত ঘোমটা দিয়ে হাসতেন। শাশুড়ি দেখলে রক্ষে আছে? পরপুরুষ চুল দেখলে বিরক্ত হবেন। হাজার হোক কাজিবাড়ির বউ বলে কথা। বোরকা না পরলেও এ বাড়ির সবাই পর্দা করেন। জোহরা অবশ্য এসেছেন অনেক উদার সংস্কৃতিমনা বাড়ি থেকে। ওনার এই সব নিয়ম-কানুন অবশ্য খুব খারাপ লাগে না। ঢাকায় তো উনি আর আধ হাত ঘোমটা দিয়ে ঘোরেন না। মাত্র তো কয় দিনের ব্যাপার।

অবশ্য মার্চ মাসের শেষে একদিন ওনার চড়ুইভাতি জীবনে ছন্দপতন ঘটল। খবর এলো বড় বাজারে মিলিটারি এসেছে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। জোহরা তার শাশুড়ির সঙ্গে পুকুরের পানিতে মেহজাবিনকে কোলে নিয়ে লুকিয়ে পড়ল। বড় বড় কচুরিপানার মাঝে হাঁটুপানিতে লুকিয়ে রইল মা-কন্যা। সুন্দরী মেয়ে বলে বাড়তি বিপদ। আর একবার শুনেছেন কোথাও মিলিটারিরা নাকি পানি দেখলে ভয় পায়। সেদিন ঠান্ডা লেগে গিয়েছিল পানিতে দাঁড়িয়ে। এর মধ্যে গ্রামের চেয়ারম্যান নিয়ে এসেছে মিলিটারি কাজিবাড়িতে।

উঠানে দাঁড়িয়ে হাঁকডাক করছেন। জোহরা যেন এখনও স্পষ্ট শুনতে পায়। ‘আকবর আর আকবরের বাপ তোমরা কোথায়?’

জোহরার শ্বশুর বুড়ো মানুষটা এগিয়ে যায় বাড়ির দিকে। চোখের ইশারায় বাড়ির অন্যদের চুপ করে লুকিয়ে থাকতে বলেন। তিনজন নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। কারও মুখে আওয়াজ নেই। জোহরা মেহজাবিনকে বুকে জড়িয়ে রেখেছেন। এর মাঝে আকবরের হাঁপানির টান উঠল।
জোরে কেশে ফেলতেই চেয়ারম্যানেরই গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। ‘আকবর বাপজান এদিক আসো।’ আকবর উঠে গেল পুকুর থেকে। এবার ইশারা করে স্ত্রী আর মাকে বলল পেছনের আমবাগান দিয়ে পালিয়ে যেতে।

হাঁটু পর্যন্ত ভেজা শাড়ি নিয়ে অন্ধকারে জোহরা ছুটছেন। পেছনে বয়স্ক শাশুড়ি আর কোলে শিশুকন্যা। প্রথম গুলির শব্দের সঙ্গে শ্বশুরের আর্তচিৎকার শুনলেন জোহরা।

পিতার চোখের সামনে পুত্রের মৃত্যু পৃথিবীর কঠিনতম শাস্তি। দোজখের যন্ত্রণা বুঝি এর চেয়ে কম হবে এমন ভাবলেন আকবরের বাবা। পরকালের কথা বেশি ভাবতে হলো না ওনার। পুত্রের লাশ ধরে আহাজারিরত বাবাকে গুলি করে মারল শয়তানগুলো। ফিরতেই যাবেন শাশুড়ি চোখ গরম করে বললেন পালা জোহরা। দৌড়া।

দ্বিতীয় গুলির শব্দের সঙ্গে আকবরের কোনো চিৎকারের শব্দ আর ভেসে আসেনি। উনি একবার থমকে দাঁড়ালেন। তারপর কোলের কন্যার দিকে তাকিয়ে জোরে দৌড় দিলেন। চোখের পানি ফেলারও সময় নেই হাতে।

অন্যদিকে কাজিবাড়ি তখন মৃত্যুপুরী। নিজের জীবনের বিনিময়ে মিলিটারিদের কাছে নিজের সন্তানের জীবনভিক্ষা চেয়েছিলেন আকবরের বাবা। এ জন্য আগে আকবরকে গুলি করেছিল পাকিস্তানি হায়েনাগুলো। মাগরিবের ওয়াক্ত। আজানের মিষ্টি সুর ভেসে আসছে। আকবর তার সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তৈরি হয়ে চোখ বন্ধ করলেন। দুই ঠোঁট নড়ছে।

মিলিটারিরা যখন ওদের বাড়ির গরু জবাই দিচ্ছে তখন বাবা-ছেলের রক্ত শুকিয়ে যায়নি। সেদিন কল পাড়ে জমে ছিল পোষা গরু লালির রক্ত। আর উঠানের দুই কোনায় বাবা-ছেলের গড়িয়ে যাওয়া রক্ত জমাট বেঁধেছিল। আশ্চর্য ব্যাপার মৃত্যুর পরে মানুষের রক্ত আর পশুর রক্তে পার্থক্য করা যাচ্ছিল না।

এরপর মিলিটারিরা পাশের মসজিদে আশ্রয় নিল। অল্প বয়সি ইমামের নাম শফিক। শফিককে জিজ্ঞেস করল কাজিবাড়ির মেয়েরা কোথায় ও জানে কি না। শফিক বলল, ও জানে না। পরদিন সকালে যেন ওদের খুঁজে বের করা হয় এমন নির্দেশ দিল ওদের কমান্ডার। শফিক ওই বাড়ির চাচিকে দেখেছে খুব কম। তবে ভারি মিষ্টি করে হাসেন জোহরা চাচি। শফিক জানে আজকে রাতে ও শয়তানের হাতে পড়েছে।

শফিকের ওপরে নজর রাখছে শয়তানগুলো। ও মিলিটারিদের বলল, ও পাশের পুকুর থেকে ওজুর পানি নিয়ে আসতে যাবে। তখন ফজরের ওয়াক্ত। মিলিটারিরা গরুর মাংস খেয়ে মসজিদে ঘুম দিচ্ছে। শফিকের দিকে খুব একটা খেয়াল করল না। ও জোরে দৌড় দিল। ও দ্রুত ভাবছে চাচি কোথায় থাকতে পারে। পাশের গ্রামের সরকারবাড়িতে কি একটু খোঁজ নেবে? শফিক জোহরাকে সরকারবাড়িতেই পেল।

শফিককে দেখে চমকে গেলেন জোহরা। ওনার কাছে খবর এসেছে মিলিটারিরা নাকি মসজিদের আশপাশেই আছে। শফিক কি ওনাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে?

শফিকের কথা কেউ বিশ্বাস করছে না। শফিক বারবার বলছে জোহরাকে পালাতে হবে। তাও শহরের দিকে। একজন স্বল্প পরিচিত অল্প বয়সি ছেলের কথা কেউ কেন বিশ্বাস করবে? তাও আবার এমন পরিস্থিতে যখন মানুষের হিংস্র রূপ দেখেছেন জোহরা। শফিক এবার জোহরার কাছে বসে বলল, ‘চাচি। আমি খুব অল্প বয়সে এতিম হয়েছি। মায়ের চেহারা আমার স্মরণ নাই। কিন্তু আপনে যখন আমার দিকে তাকায়ে হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করতেন ভালো আছ বাবা? তখন আমার মনে হতো আমার আম্মা আমার সঙ্গে কথা বলছে। চাচি আপনার এই ছেলেরে আপনি বিশ^াস করেন। আপনার অনেক বিপদ।’

শাশুড়ি তখন কেঁদে চলেছেন। ছোট ছেলে আর স্বামী একসঙ্গে হারিয়ে পাগলপ্রায়। জোহরা ওনার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে উনি বললেন, ‘বউ এখান থেকে পালাও। আজরাইল আসছে।’

জোহরা কোলের মেয়েকে নিয়ে শফিকের হাত ধরে সরকারবাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। প্রায় তিন দিন ধরে হেঁটে আর গরুর গাড়ির পেছনে চড়ে জোহরা তার বাবার বাড়ি পৌঁছলেন। জোহরার বাবা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না।তার মেয়ে জীবিত ফেরত এসেছে।
উনি শুনেছিলেন জোহরার শশুড়বাড়ির গ্রামের সবাইকে মিলিটারি মেরে ফেলেছে। শফিক যাওয়ার আগে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলল, ‘আম্মা আমি আসি।’

শফিকের গমন পথের দিকে তাকিয়ে জোহরার চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। এখন উনি মন খুলে কাঁদবেন।

জোহরার বাবা ক্ষমতাবান মানুষ। উনি শফিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন। হাতে টাকা আর বিশ্বস্ত মানুষের সঙ্গে ওকে বর্ডার পার করে ভারতে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সন্তান-সন্ততি নিয়ে এরপর উনি খামারবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। যুদ্ধের পুরো সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন। তার এক কন্যার স্বামী যে যুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন সেই যুদ্ধে উনি নিজের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
আজকেও জোহরা যেন দেখছেন শফিক ওনার কাছে যেন বিদায় নিচ্ছে।

উনি ইনহেলারটা হাতে নিয়ে ভাবেন, সেদিন এটা ওনার হাতে থাকলে মেহজাবিনের বাবার কাশির শব্দ হায়েনারা শুনতে পেত না। আহারে সেদিন যদি ইনহেলারটা ওনার কাছে থাকত মানুষটা আজ বেঁচে থাকত।

শেয়ার