Bangla24.Net

কতো রঙ্গ জানো রে মোবাইল

জীবনে তো কত গানই শুনলাম। কোনোটা বেসুরো, কোনোটা সুরো। কোনোটা মনে আছে, কোনোটা মনের আশপাশেও নেই। মনে আছে, এমন একটা গান হচ্ছে-‘কত রঙ্গ জানো রে মানুষ, কত রঙ্গ জানো, তুমি এই ভালো এই মন্দ, ক্ষণে হাসো ক্ষণে কান্দো।’ না, আর মনে করতে পারছি না। অবশ্য দরকারও নেই। যতটুকু মনে আছে, ততটুকুর সারমর্ম হচ্ছে, মানুষ নানা রকমের রঙ্গ জানে। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি, মানুষ যত রঙ্গ জানে, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি রঙ্গ জানে মোবাইল। ইয়েস, আমার মোবাইল। মোবাইল প্যান্ট না কিন্তু। মোবাইল ফোন।

কিছুদিন আগে আমি এমন একটা মোবাইল চালাতাম, যেটা ছিনতাইকারীরাও নিতে চাইত না। বলত এত কম দামি মোবাইল নিলে নাকি তাদের প্রেস্টিজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ছিনতাইকারীদের প্রেস্টিজের কথা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, দামি একটা সেট কিনব। এরপর কিনেও ফেললাম। এমনিতেই দামি সেট আবার সাইজেও বড়। সহজে পকেটে ঢুকতে চায় না। ঠেলেঠুলে ঢোকাতে গিয়ে দুয়েক জায়গার সেলাইও ছুটে গেল।

দামি এবং বড় সাইজের মোবাইল কেনার পর আমার ভাব যখন বেড়ে যাচ্ছে যাচ্ছে করছে, ঠিক তখনই দেখা দিল বিরাট এক সমস্যা। সমস্যাটা চার্জ-সংক্রান্ত। কোনোমতেই চার্জ নিচ্ছিল না। অথচ কতভাবে চেষ্টা করছিলাম। তারপর একসময় বন্ধই হয়ে গেল। নিয়ে গেলাম দোকানে। মুদি দোকানে না, চায়ের দোকানেও না। মোবাইলের দোকানে। মানে যে দোকান থেকে মোবাইলটা কিনেছিলাম।

দোকানদারকে বিষয়টা খুলে বললাম। কিছুটা গোসসাও প্রকাশ করলাম। নতুন মোবাইলে চার্জ-সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দেবে, গোসসাও প্রকাশ করব না? এই ধরনের পরিস্থিতিতে গোসসাও প্রকাশ তো আমার নাগরিক অধিকার। দোকানদার কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে বলল-নতুন মোবাইল অথচ চার্জ নেবে না-এমন তো হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কেন হচ্ছে সেটা জানতে হলে একটু সময় লাগবে।

আমি জানতে চাইলাম কতক্ষণ সময় লাগবে। দোকানদারের ভাবভঙ্গি এবার বদলে গেল। সে গলার স্বরেও খানিকটা পরিবর্তন এনে বলল-আপনার প্রশ্নটা ঠিক হয় নাই। কতক্ষণ সময় লাগবে জিজ্ঞেস না করে জিজ্ঞেস করেন কতদিন সময় লাগবে। এই ধরেন চার-পাঁচদিন সময় তো লাগতেই পারে। আর যদি আপনার কপাল মন্দ হয়, তা হলে আরও সময় লাগতে পারে। মনে করেন সাত-আট দিন। কপাল বেশি মন্দ হলে দশ দিন।

দোকানদারের কথা শুনে আমি আকাশ থেকে না পড়লেও সাততলার ওপর থেকে পড়লাম বলে মনে হলো। আসলে দোকানটা সাততলার ওপর ছিল তো! আমি চোখ কপালে তুলে বললাম-বলছেন কী আপনি! সামান্য একটা সমস্যা সমাধান করতে এত সময় লাগে? আপনাদের লোকজন এত অদক্ষ কেন? আরে ভাইরে আট-দশ দিন সময় যদি লেগে যায় মোবাইল মেরামত করতে, তা হলে এই কদিন আমি চলব কীভাবে?

দোকানদার হেসে বলল-কী যে বলেন না আপনি। আমি চলব কীভাবে, এটা কোনো প্রশ্ন হলো? চলার জিনিসের অভাব আছে? রিকশা দিয়ে চলবেন। বাস দিয়ে চলবেন। সিএনজি দিয়েও চলতে পারেন। যদি মনে করেন লেগুনা দিয়ে চলবেন, সেটা আপনার ইচ্ছা। চলতেই পারেন। এ ছাড়া লেগুনার ভাড়াও কম।

আমি দোকানদারকে ফাজলামো করতে নিষেধ করলাম। আর অনুরোধ করলাম একটা সমাধান দেওয়ার জন্য। দোকানদার আমাকে অবাক করে দিয়ে একটা সমাধান দিল। সমাধানটা হচ্ছে, নতুন একটা মোবাইল। বলল-যেহেতু এত দাম দিয়ে কেনা মোবাইলটাতে সমস্যা দেখা দিয়েছে, অতএব নতুন মোবাইল আপনি পেতেই পারেন। আর আমরাও আপনাকে নতুন মোবাইল দিতে বাধ্য। কাস্টমারের প্রতি আমাদের একটা দায়বদ্ধতা আছে না?

আমি দোকানদারকে ধন্যবাদ দিলাম। খুশিতে গদগদ হয়েই দিলাম ধন্যবাদটা। তারপর নতুন মোবাইল নিয়ে চলে এলাম বাসায়। আর খানাপিনার পর আয়েশের উদ্দেশ্যে বিছানায় একটু পিঠ ছোঁয়ালাম। ফেসবুক দেখার সদিচ্ছা অথবা বদিচ্ছা জাগল। কিন্তু অন করতে গিয়ে দেখি আবার সেই সমস্যা। চার্জ নেই। ছুটে গেলাম দোকানে। এবার আর অভিমান না, রাগ ঝাড়লাম। তবে দোকানদার আমার রাগ দেখে মোটেই বিচলিত হলো না। ভয় পেল বলেও মনে হলো না। সে মোবাইলটা উল্টেপাল্টে দেখে বলল-এই ব্যাপারে আর কথা না বলে আস্তে করে চলে যান। কারণ কেউ যদি শোনে আপনার কপালে শুধু সমস্যাগ্রস্ত মোবাইলই পড়ে, সবাই কিন্তু জেনে যাবে আপনি একটা কুফা। তখন জীবনেও বিয়েশাদি করতে হবে না।

আমি হুংকার ছাড়লাম। আল্টিমেটাম দেওয়ার মতো করে বললাম আমার বিয়েশাদি নিয়ে দোকানদারকে ভাবতে হবে না। বিয়ে আমি কবেই করে ফেলেছি। আর আদেশ করলাম, সাতপাঁচ না বুঝিয়ে যেন সমস্যার সমাধান দেয়। দোকানদার সমাধান দিল। তাদের অপারেটরকে দিয়ে মেরামত করিয়ে দিল দুই ঘণ্টার মধ্যে। আমি মনে করেছিলাম ফ্রি সার্ভিসিং। কিন্তু না, চার হাজারেরও বেশি টাকা সে দাবি করে বসল। অনেক কষাকষির পরও যখন তার দাবি উপেক্ষা করতে পারছিলাম না, তখন টাকা পরিশোধ করেই দোকান ছাড়তে হলো।

মোবাইল নিয়ে বাসায় ফিরলাম। দুদিন শান্তিতেই কাটল। তৃতীয় দিনে দেখা দিল আরেক সমস্যা। সমস্যাটা এমন-কেউ ফোন করলে অথবা আমি কাউকে ফোন করলে ওপাশের কথা বেশ আস্তে আস্তে শোনা যায়। এক কথায় বললে বলতে গেলে, শোনাই যায় না। ওপাশ থেকে কেবল ফিসফিস শব্দ আসে। আমি কিচ্ছু বুঝতে পারি না। গলার স্বর উঁচুতে তুলে বারবার বলতে হয়-কী বললেন? আবার একটু বলেন। আরে না, এইবারও বুঝতে পারি নাই। আরেকটু জোরে বলেন। জি জি, আরেকটু জোরে বলেন।

ছুটলাম দোকানে। সমস্যার কথা জানাতেই দোকানদার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তবে তাকিয়ে তাকিয়ে কী দেখছিল, বোঝা যাচ্ছিল না। আমি বোঝার চেষ্টা করলাম। তারপর জানতে চাইলাম কী দেখছে। দোকানদার বলল-রোগী দেখতেছিরে ভাই, রোগী দেখতেছি। আমি যদিও ডাক্তার না, তবু রোগী দেখতেছি। রোগী যদি আইসা ঘাড়ের ওপর পড়ে, তাইলে না দেইখা উপায় কী? উপায় আছে কোনো? নাই।

আমি ডানে-বামে তাকালাম। খুঁজলাম আশপাশে কোনো রোগী আছে কি না। আমার এই তাকাতাকি দেখে দোকানদার হাসল। আমি জানতে চাইলাম কেন হাসছে। দোকানদার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না। সে পকেট থেকে মোবাইল বের করল। তারপর কার নম্বর যেন ডায়াল করল। মিনিটখানেক কথাও বলল। তারপর লাইন কেটে দিয়ে মোবাইলটা রেখে দিল আগের জায়গায়। আর দোকানের ছেলেটাকে বলল-এই, উনাকে খলিল সাহেবের কাছে নিয়ে যা, আমি এইমাত্র কথা বলেছি। তিনি দোকানেই আছে, যা।

ছেলেটা হাঁটা শুরু করল। তবে তার আগে ছোট করে একটা ইঙ্গিত দিল। যে ইঙ্গিতের অর্থ-হাই ব্রো, ফলো মি। আমি ছেলেটাকে ‘ফলো’ করতে লাগলাম। সে আমাকে নিয়ে গেল খলিল সাহেবের কাছে। আমি নিশ্চিত ছিলাম, মানুষটা মোবাইল অপারেটর। কিন্তু যখন বুঝলাম ভদ্রলোক কানের ডাক্তার, তখন তো আমি তাজ্জব। তৎক্ষণাৎ আমার অবস্থা এমন হয়ে গেল-‘কী করি আজ ভেবে না পাই, পথ হারিয়ে কোন বনে যাই, কোন মাঠেতে ছুটে বেড়াই।’

খলিল সাহেব যৎসামান্য হাসলেন। তারপর বললেন-মোবাইলে কথা বলার সময় কেন ওপাশের কথা আস্তে শুনছেন, এটা কিন্তু এমনিতেই বলা যাচ্ছে না। কান টেস্ট করতে হবে। তার আগে দেখতে হবে কানে খৈল জমেছে কি না। আসেন তো, এদিকে আসেন। কানটা একটু নিচু করেন। বলেই খলিল সাহেব আমার কানে টর্চ মারলেন।

শেয়ার