সোনার তরী’ কবিতাটি পরিকল্পিত হয় বর্ষার এক অপরাহ্ণে। ধান বোঝাই নৌকার নদী পাড়ি দেওয়ার দৃশ্য দেখে কবিতাটির পরিকল্পনা আসে রবীন্দ্রনাথের মনে। কবিতাটি রচিত হয় বসন্তে (ফাল্গুন ১২৯৮ : ফেব্রুয়ারি ১৮৯২); প্রকাশিত হয় ‘সাধনা’র আষাঢ় ১৩০০ সংখ্যায় (জুন ১৮৯৩)।
কবিতাটি এমন সময়ে রচিত হয়, যখন জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ শিক্ষিত সমাজকে ঐতিহ্যসচেতন করে তুলেছিল। সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এর প্রকাশ দেখা দিয়েছিল লোকসাহিত্যের উপকরণ প্রকাশে ও পুুথি আবিষ্কারে। এই সময়টাকে বলা যায় পল্লীসংযোগের যুগ। রাজনীতিতে যেমন নতুন যুগ, তেমনি সাহিত্যের ইতিহাস রচনা ও পুথি সাহিত্য সংগ্রহে নতুন যুগ। সে সময়ে জমিদারি কার্যভার গ্রহণ করে রবীন্দ্রনাথ অবস্থান করছিলেন বাংলাদেশের গ্রামে। কবিতার পটভূমি এ রকম : ‘ছিলাম তখন পদ্মার বোটে। জলভারনত কালো মেঘ আকাশে, ও-পারে ছায়াঘন তরুশ্রেণির মধ্যে গ্রামগুলি, বর্ষার পরিপূর্ণ পদ্মা খরবেগে বয়ে চলেছে, মাঝে মাঝে পাক খেয়ে ছুটেছে ফেনা। নদী অকালে কূল ছাপিয়ে চরের ধান দিনে দিনে ডুবিয়ে দিচ্ছে। কাঁচা ধানে বোঝাই চাষিদের ডিঙি নৌকা হুহু করে স্রোতের ওপর দিয়ে ভেসে চলেছে।’
লোহিত সাগরের জলরাশি পাড়ি দিয়ে দেশে ফিরে জীবনকে নতুনভাবে আবিষ্কার করলেন রবীন্দ্রনাথ। ভাঙাগড়ার প্রতীক পদ্মার বিশাল জলতরঙ্গের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর জীবনে এলো বিশাল পরিবর্তন। জাতীয় জীবনেও এক নবজীবনের সূচনা হয় এ সময়। বাংলাদেশের বৃহৎ বাস্তব জগতের সঙ্গে পরিচিত হওয়ায় নতুন ফসল ফলে উঠল ‘সোনার তরী’ কবিতায়। ‘সোনার তরী’ কবিতার প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য কর্মময় জগতের উপস্থাপনা-যেখানে এসে মিশেছে বাংলাদেশের কৃষকের জীবন।
রবীন্দ্রনাথের জন্য তার আগের যুগ ছিল শিক্ষানবিশির কাল। সন্ধ্যাসংগীত-প্রভাতসংগীত পর্বের কবিতা লেখার সময় তার জীবন কাটে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে, ৪৯ পার্ক স্ট্রিটে বা পশ্চিমের কোনো নিভৃতবাসে। ১৮৮৪ সালে প্রকাশ হয় ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’। মৈথিলী ভাষার গঠনাকৃতি ভেঙে বাংলার মতো এক ভাষায় লিখিত হয়েছিল এ কবিতা। বৈষ্ণব পদাবলী আশ্রিত রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা নিয়ে মধ্যযুগে এ ধরনের কবিতা লিখেছিলেন নরোত্তম দাস, বলরাম দাস ও গোবিন্দ দাস। বাউল গানের সঙ্গে পরিচয়ের পর ১৮৮৩ সালে লিখেছিলেন ‘বাউল গান’ নামে প্রবন্ধ। ছবি ও গান-মানসী পর্বের কবিতায় সংগীতের সঙ্গে যুক্ত হয় চিত্র। এ সবই কলকাতা পর্বের রচনা। পূর্ববঙ্গে আসার পর হলো কর্মের অভিষেক। ‘মানসী’ আনন্দময়, আবেগময়, চির-আন্দোলিত কবিহৃদয়ের স্পর্শে ধন্য; অন্যদিকে প্রাত্যহিক জীবনের ভেতরকার অমৃতের সন্ধান দিয়ে ‘সোনার তরী’ হয়ে ওঠে অনন্য।
পূর্ববঙ্গে বসবাসের আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন শুধুই সাহিত্যের পথে-তার অভিজ্ঞতার জগতে ছিল পেনেটি, হিমালয় বা চন্দননগর। তার গল্পের নাম ছিল ‘ঘাটের কথা’ ও ‘রাজপথের কথা’। পূর্ববঙ্গে আসার পর প্রধান হয়ে উঠল সোনার তরীর খেয়াঘাট ও গ্রামের পথ। তার জীবনে যুক্ত হলো একটি নতুন অধ্যায়-যাকে বলে নদী, নৌকা ও কর্মের জগৎ। সবচেয়ে মূল্যবান হলো নতুন জীবনবোধ। যার মর্মকথা হলো : ‘জীবনের ক্ষেতটুকু দ্বীপের মতো-চারদিকেই অব্যক্তের দ্বারা সে বেষ্টিত-শুধু একটুখানিই তার কাছে ব্যক্ত হয়ে আছে।’ রবীন্দ্রনাথ যার ব্যাখ্যা করছেন এভাবে : ‘প্রত্যেক মানুষ জীবনের কর্মের দ্বারা সংসারকে কিছু না কিছু দান করছে, সংসার তার সমস্তই গ্রহণ করছে, রক্ষা করছে, কিছুই নষ্ট হতে দিচ্ছে না-কিন্তু মানুষ যখন সেই সঙ্গে অহংকেই চিরন্তন করে রাখতে চাচ্ছে তখন তার চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। এই যে জীবনটি ভোগ করা গেল অহংটিকেই তার খাজনাস্বরূপ মৃত্যুর হাতে দিয়ে হিসাব চুকিয়ে যেতে হবে-ওটি কোনোমতেই জমাবার জিনিস নয়।’ যার মূল বাণী হলো : মানুষ অহংকারের মধ্যে বাঁচে না, বাঁচে আত্মনিবেদন ও আত্মোৎসর্গের মধ্যে। ইতিহাস কোনো ব্যক্তিকে গ্রহণ করে না, ইতিহাস শুধু গ্রহণ করে নিঃশ্রেয়স সত্য, নিঃস্বার্থ দান ও অবদান।
‘মানসী’ রচনার যুগে বেড়াতে গিয়েছিলেন পশ্চিমে, যেখানে বহু শতাব্দী ধরে বহু সাম্রাজ্যের উত্থানপতন হয়েছে এবং নব নব ঐশ^র্যের বিকাশ ও বিলয় ঘটেছে। সে সময়ে লেখা কবিতাগুলোতে আছে অতীতের স্মৃতি, অতৃপ্ত বাসনা বা আকাক্সক্ষার আবেগ। পশ্চিম ভারতে গিয়ে দেখলেন যবের ছোলার শস্যের ক্ষেত আর পূর্ব বাংলায় এসে দেখলেন :
‘রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হল সারা,
ভরানদী ক্ষক্ষুরধারা খরপরশা।’
গাজীপুরে ডাকবাংলোয় অবস্থানকালে দূর থেকে দেখেছিলেন গঙ্গার জলধারা-যেখানে গুন-টানা নৌকা চলেছে ধীরগতিতে। বাংলাদেশে এসে দেখলেন হাওয়া লাগা অমল ধবল পাল :
‘ভরা-পালে চলে যায়
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু ধারে-
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।’
বাস্তব জীবনের কাছাকাছি আসার পর মানুষ হয়ে উঠল পরিচিত প্রধান বিষয়বস্তু। বাংলাদেশের নদী নৌকা ও কর্মের জগৎ হয়ে উঠল তার পরবর্র্তী জীবনের কর্মপ্রেরণা। ‘সোনার তরী’র সূচনায় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘এইখানে নির্জন-সজনের নিত্যসঙ্গম চলেছিল আমার জীবনে। অহরহ সুখ-দুঃখের বাণী নিয়ে মানুষের জীবনধারার বিচিত্র কলরব এসে পৌঁছাচ্ছিল আমার হৃদয়ে। মানুষের পরিচয় খুব কাছে এসে আমার মনকে জাগিয়ে রেখেছিল। তাদের জন্য চিন্তা করেছি, কাজ করেছি, কর্তব্যের নানা সংকল্প বেঁধে তুলেছি, সেই সংকল্পের সূত্র আজও বিচ্ছিন্ন হয়নি আমার চিন্তায়। সেই মানুষের সংস্পর্শেই সাহিত্যের পথ এবং কর্মের পথ পাশাপাশি প্রসারিত হতে আরম্ভ হলো আমার জীবনে।’ কর্মের পথ প্রসারিত হলো
এভাবে যে-রথীন্দ্রনাথ ও সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে কৃষিবিদ্যা ও গোপালনবিদ্যা অধ্যয়নের জন্য আমেরিকায় পাঠান (১৯০৬) রবীন্দ্রনাথ। পুত্র ও জামাতা আমেরিকা থেকে কৃষিবিদ্যা শিখে এলে- তাদের সপরিবারে বসালেন শিলাইদহে। পল্লী উন্নয়নের লক্ষ্যে নোবেল পুরস্কারের ১ লাখক্ষ ৮ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে পতিসরে স্থাপন করেন কৃষি ব্যাংক, কৃষিজমি চাষের জন্য ট্রাক্টরের ব্যবহার করেন এখানেই প্রথম। শাহজাদপুরে কৃষকের ভাগ্য উন্নয়নে ও আধুনিক প্রযুক্তি শিক্ষাদানের জন্য স্থাপন করেন শ্রীনিকেতন।
সূত্র : সময়ের আলো